কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (QE) এর সংজ্ঞা ভিন্ন এবং বিতর্কিত হিসেবে আসতে পারে। কিন্তু মূলত এটি একটি জাতির অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার অভিপ্রায়ে হওয়া একটি মার্কেট অপারেশন (কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দ্বারা সঞ্চালিত) যা তারল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করে যা ব্যবসা এবং ভোক্তাদের ঋণ নিতে ও আরো ব্যয় করতে উৎসাহিত করে।
এটি কিভাবে কাজ করে?
সাধারণত, এই অপারেশনে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে যা সরকার বা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সিকিউরিটিজ (যেমন স্টক, বন্ড এবং ট্রেজারি অ্যাসেট) ক্রয় করে অর্থনীতিতে অর্থ প্রবেশ করায়।
এই সদস্য ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ ফান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নতুন ক্রেডিট সম্প্রসারণের মাধ্যমে যোগ করে (যা ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথে পরিপালনের মাধ্যমে রাখা যায়)। নতুন ক্রেডিট যেহেতু কোনো পণ্য বা প্রকৃত মূল্যের কোনো কিছুর দ্বারা সমর্থিত নয় তাই QE মূলত অর্থ তৈরি করে না।
অতএব, QE-এর উদ্দেশ্য হলো অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি করা, যা অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার উপায় হিসেবে এটিকে আরো বেশি অ্যাক্সেসযোগ্য করে তোলে। ধারণাটি হলো সুদের হার কম রাখা, ব্যবসা এবং ভোক্তাদের জন্য ঋণ প্রদান ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে আস্থা বৃদ্ধি করা। তবে বাস্তবে QE সবসময় কাজ করে না এবং এটি আসলে একটি খুব বিতর্কিত পদ্ধতি, সমর্থক ও বিরোধী উভয়ের জন্যই।
QE একটি অপেক্ষাকৃত নতুন সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এটির প্রথম বাস্তব-বিশ্ব ব্যবহার (তর্কাতীতভাবে) 1990-এর দশকের শেষের দিকে জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ব্যাংক অব জাপান) করেছিল। এটি তর্কসাপেক্ষ কারণ অনেক অর্থনীতিবিদ জাপানের সেই সময়ের আর্থিক অনুশীলন সত্যিই QE ছিল কি না সে বিষয়ে উল্টো যুক্তি দেন। তারপর থেকে, অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা হ্রাস করার প্রয়াস হিসেবে QE অনুশীলন প্রয়োগ করেছে।
কোন বিষয়টি কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং এর ব্যবহারকে অনুপ্রাণিত করেছিল?
প্রচলিত আধুনিক ব্যাংকিং অনুশীলনগুলো যখন মন্দা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন যে সমস্যাগুলো দেখা দেয় তার সমাধানের জন্য QE তৈরি করা হয়েছিল। QE-এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করা (সংকোচন এড়াতে) - এবং সুদের হার সমন্বয় হলো প্রধান হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করে। ঋণ গ্রহণ এবং আর্থিক কার্যকলাপ ধীর হয়ে গেলে একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকর ঋণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এটিকে আরো সাশ্রয়ী করতে হার কমিয়ে দিতে পারে। বিপরীতে, পরিস্থিতি যখন কিছুটা অধিক মুক্ত হয়ে যায় - খরচ ও ক্রেডিট ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে পৌঁছে যায় - তখন একটি উচ্চ সুদের হার কিছুটা বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।
কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং কি কার্যকর?
2008 সালের আর্থিক সঙ্কট শেষ হওয়ার কিছুকাল পরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) একটি নোট প্রকাশ করে যেখানে QE একটি কার্যকর অপ্রচলিত মুদ্রানীতি হিসেবে বলা হয়। বিশ্লেষণের মধ্যে পাঁচটি প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত ছিল: ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ব্যাংক অব কানাডা এবং ব্যাংক অব জাপান।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটি ইউনিক কৌশল ডেপ্লয় করলেও অধিকাংশই নাটকীয়ভাবে সামগ্রিক মার্কেটের তারল্য বৃদ্ধি করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর করা হস্তক্ষেপ সফল হয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকট ও আর্থিক ব্যবস্থার মন্দা এড়াতে তারল্য বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তবে, QE সবসময় কার্যকর হয় না এবং এটি পরিস্থিতি ও কৌশলের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। QE (বা অনুরূপ পদ্ধতি) ব্যবহার করে পরীক্ষা করা অনেক অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব বয়ে আনেনি। সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে অর্থনীতিতে অর্থ প্রবেশ করানো এবং সুদের হার কমানোর কাজটি অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের কারণ হতে পারে। নিচে আমরা সম্ভাব্য কিছু সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ তালিকাভুক্ত করেছি।
সম্ভাব্য সুবিধা ও ইতিবাচক প্রভাব
অধিক ঋণ প্রদান: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাসেট ক্রয়ের ফলে তাদের ফান্ড বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোকে আরো ঋণ দিতে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা।
বর্ধিত ধার গ্রহণ: সুদের হার কম হলে ভোক্তা ও ব্যবসার নতুন ঋণ গ্রহণ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অধিক ব্যয়: সকল নতুন ঋণ দেওয়া এবং ধার নেওয়ার ফলে বেশি পরিমাণে অর্থ উৎপন্ন হওয়ায় ভোক্তারা তাদের ব্যয় বাড়াবে। সুদের হারের কম হলে অর্থ সঞ্চয়ে ফেলে রাখা আকর্ষণীয় নয়।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: ব্যবসাগুলো ঋণের মাধ্যমে অধিক পুঁজির অ্যাক্সেস পাওয়ার এবং ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিক্রি বেশি হওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরো বেশি কর্মী নিয়োগ করতে এবং সম্প্রসারিত করতে উৎসাহিত হয়।
সম্ভাব্য অসুবিধা ও নেতিবাচক প্রভাবসমূহ
অনেক বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে QE হলো বৃহত্তর, কাঠামোগত সমস্যাগুলোর জন্য একটি ব্যান্ড-এইড যা শেষ পর্যন্ত এক সময় অর্থনীতিকে ব্যর্থ করবে। সম্ভাব্য কিছু অসুবিধার মধ্যে আছে:
মুদ্রাস্ফীতি: QE দ্বারা সৃষ্ট বর্ধিত অর্থ সরবরাহ স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতিসৃষ্টি করে। অধিক অর্থ সঞ্চালন হলেও পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি না পাওয়ার পণ্যের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়বে। বেশি চাহিদার কারণে মূল্য বেড়ে যায়। সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে মুদ্রাস্ফীতির হার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে যা হাইপারইনফ্লেশনের দিকে পরিচালিত করে।
কোনো জোরপূর্বক ঋণ নেই: QE-তে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করে আরো ঋণ দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রক্রিয়ায় মধ্যে এমন কিছু নেই যা এটি করতে তাদের বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, 2008 সালের আর্থিক সংকটের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিকভাবে QE প্রয়োগ করার সময় অনেক ব্যাংক তাদের নতুন সম্পদকে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধরে রেখেছিল।
অধিক ঋণ: বর্ধিত ঋণ সুবিধার কারণে ব্যবসা ও ভোক্তা তাদের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক ফলাফল আনতে পারে।
বিনিয়োগের অন্যান্য উপকরণকে প্রভাবিত করে: ঘন ঘন অস্থিরতা ও আকস্মিক পরিবর্তনে বন্ড মার্কেটে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ে যা QE নীতি বাস্তবায়ন করার পরে বেশ প্রচলিত ঘটনা।
উদাহরণ
কিছু কিছু দেশ যাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং এর ব্যবহার করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে:
ব্যাংক অব জাপান: 2001-2006 এবং 2012-বর্তমান (অ্যাবেনোমিক্স)।
QE প্রচেষ্টা তাদের আর্থিক সমস্যার সমাধান করেনি। মার্কিন ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েন দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আমদানির খরচ বেড়েছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: 2008-2014।
আবাসন সংকট ও পরবর্তী মন্দা মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র QE-এর তিন রাউন্ড বাস্তবায়ন করেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হলেও এটি QE-এর কারণে হয়েছিল কিনা তা বিতর্কিত। QE ব্যাংকিং অনুশীলন ব্যবহার না করা কানাডার সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে উল্লেখযোগ্য কোনোপার্থক্য দেখা যায়নি।ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক: 2015-2018।
স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব হ্রাস এবং 2017 সালের একটি শক্তিশালী অর্থনীতিসহ ইউরোজোনের কিছু সাফল্য ও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে, তবে এটি এখনও মজুরি বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান সুদের হার নিয়ে কাজ করছে।
শেষ কথা
অপ্রচলিত একটি আর্থিক কৌশল হিসেবে QE কিছু অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে, তবে এটি অবশ্যই একটি বিতর্কিত কৌশল এবং এমনকি এই উপসংহারটিও বিতর্কিত। হাইপারইনফ্লেশন এবং অত্যধিক ঋণের মতো অধিকাংশ সম্ভাব্য ঝুঁকি এখনও কোনো ধ্বংসাত্মক পরিণতি সৃষ্টি করেনি তবে QE ব্যবহার করা কিছু কিছু দেশ মুদ্রার অস্থিরতা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও মার্কেটের উপর ক্ষতিকর প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল যথেষ্ট পরিষ্কার নয় এবং QE-এর প্রভাবগুলো প্রেক্ষাপট অনুসারে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে।